ছোটদের গানই বেশীরভাগ সময় গেয়ে থাকেন শিল্পী। 'সুর ও শিল্পী'
পত্রিকায় কোনো এক একনিষ্ঠ শ্রোতা তাঁর উদ্দেশ্যে লিখলেন "আপনি বোধ হয় একটু
শিশু বৎসল, না? আপনার ছোটদের জন্য গানগুলি ভালো লাগে..." শিল্পীর উত্তর,
"অশেষ ধন্যবাদ। শিশু বাৎসল্য তো মানব প্রকৃতি।" আসলে যাঁর গান শুনে
দশকের পর দশক বাংলার ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা কল্পনার জগতে ভেসে বেড়িয়েছে, যাঁর গান
শোনার জন্য তারা মুখিয়ে থেকেছে, তাদের স্বপ্নের শিল্পীর এমন উত্তরই বোধ হয়
স্বাভাবিক। যাঁর কন্ঠে 'হাট্টিমাটিম টিম' শুনে আজও মন কেমন করে ওঠে, ফিরে
যেতে ইচ্ছা করে সেই ছোট্টবেলায়, তাঁর কাছে বাৎসল্যটা কখনই আরোপিত কিছু হতে পারেনা।
এমনি নস্টালজিয়ার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়ে
আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়।
গান - হাট্টিমাটিম টিম
উত্তমকুমারের স্নেহের 'আল্পস' - মহায়ানক বলেছিলেন, "এস
আল্পস, তুমি-আমি মিলে একটা ছবিতে নায়ক-নায়িকার অভিনয় করি। তুমি কানন দেবীর মতো
গায়িকা-নায়িকা হবে। তাহলে ছবি নির্ঘাত হিট।" সে অনুরোধ রাখতে পারেন নি আলপনা।
সঙ্গীতকেই বেছে নিয়েছিলেন পথ চলার সঙ্গী হিসাবে। প্রথমে বাবা কান্তিগোপাল
বন্দ্যোপাধ্যায় ও পরে জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের সাহচর্যে সঙ্গীতে শিক্ষা। আলপনা বলেছিলেন, "প্রেসিডেন্সি
কলেজের বোটানি বিভাগের প্রধান ছিলেন আমার বাবা। কিন্তু বাবা বাদল খাঁ'র শিষ্যও
ছিলেন। বাবার কাছে গান শিখতে সন্ধ্যাদির মতো অনেকেই আসতেন। আমি দরজার আড়াল থেকে
সেই তালিম শুনতাম। তারপর বাবা কলেজে বেরিয়ে গেলে কোলবালিশকে হারমোনিয়াম
বানিয়ে মনের সুখে গান গাইতাম।" এরকম লুকিয়ে লুকিয়েই গান শেখা শুরু!
তারপর বারো বছর বয়সে ১৯৪৮ সালে রেডিও অডিশন পাশ করে
শিল্পীজীবনও শুরু, 'ভেঙ্গোনা আমার মিলনের গান'
গানটি গেয়ে। সে বছরই বালীগঞ্জ সঙ্গীত সম্মেলনে গিয়ে প্রচুর প্রশংসা কুড়ান
আলপনা, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার-রবীন চট্টোপাধ্যায়ের হাত ধরে পেয়ে যান ছায়াছবিতে
নেপথ্যসঙ্গীত পরিবেশনের সুযোগ। কতই বা বয়স তখন? তেরো কি চোদ্দ! 'বিদ্যাসাগর'
(১৯৫০) ছবি মুক্তি পেতেই আলপনার প্রথম নেপথ্যসঙ্গীত 'মাটির ঘরে আজ নেমেছে চাঁদ'
সুপার ডুপার হিট!
আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়
মাটির ঘরে আজ নেমেছে চাঁদ রে, আজ নেমেছে চাঁদ।
বলি ও চকোরি, চোখ মেলে দেখ -
মিটুক মনের সাধ রে, মিটুক মনের সাধ।
কেন ঘোমটা দিয়ে মুখ লুকালি, এলো যে তোর্ বর,
ওযে বাঁকা ভুরুর ধনুর টানে ছড়ায় ফুলশর।
যেন পালিয়ে না যায় - চরণ দুটি
পরাণ দিয়ে বাঁধ রে, পরাণ দিয়ে বাঁধ।
রসিক ভ্রমর তুমি হে বর, তুমি রসিক বঁধু,
ফুলেরে তুষিয়া আগে পরে খেও মধু।
সিঁথায় দিও সোহাগ সিঁদূর, চরণধূলি মাথে,
চাঁদমুখে তাম্বুল দিও - শঙ্খবালা হাতে।
আর হৃদয় দিয়া হৃদয় ধরো -
পেতে প্রেমের ফাঁদ রে - পেতে প্রেমের ফাঁদ!
এর ঠিক পরের বছরই এলো গ্রামোফোন রেকর্ড করার সুযোগ।
গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার-রবীন চট্টোপাধ্যায়ের কথায়-সুরে রেকর্ড করলেন আলপনা - 'ওগো
তোমার চাওয়া' ও 'পাপিয়া কেন আর' গানদুটি। এর পরপরই শুরু হলো ছোটদের গান গাওয়া।
'খুকুর ছড়া' (কথা - প্রচলিত, সুর - নির্মল ভট্টাচার্য্য) জনপ্রিয় হলো, প্রকাশ
পাওয়ার সাথে সাথেই।
গান - ওগো তোমায় চাওয়া
গান - পাপিয়া কেন আর
গান - খুকুর ছড়া (১ম ভাগ)
গান - খুকুর ছড়া (২য় ভাগ)
১৯৫২ সালে, বঙ্গীয় চলচ্চিত্র-নাট্য সংঘের পক্ষ থেকে, 'শুভদা'
ছবির গানের জন্য পুরস্কৃত হলেন শিল্পী। ১৯৫৪ সালে 'না' ছবিতে শচীন গুপ্তর সুরে অসাধারণ একটি গান
গাইলেন শিল্পী, 'তারার চোখে তন্দ্রা এলো' - দুর্ভাগ্যের বিষয়, গানটি কখনই রেকর্ডে
প্রকাশিত হয়নি। বিভিন্ন সময় নানা অনুষ্ঠানে এই গানটি গাইতেন আলপনা - স্মৃতিচারণে
বলেছিলেন গীতিকবি পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়।
গান - তারার চোখে তন্দ্রা এলো
এরপর একে একে 'অগ্নিপরীক্ষা' (১৯৫৪), 'বিধিলিপি' (১৯৫৫),
'দস্যু মোহন' (১৯৫৫), 'দানের মর্যাদা' (১৯৫৬), 'সাগরিকা (১৯৫৬), 'অসমাপ্ত' (১৯৫৬),
'পৃথিবী আমারে চায়' (১৯৫৭), 'তাসের ঘর' (১৯৫৭), 'প্রিয়া' (১৯৫৮),
'দেড়শো খোকার কান্ড' (১৯৫৯), প্রভৃতি চিত্রে শোনা গেল
আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্ঠে গান। 'অগ্নিপরীক্ষা' ছবির 'আজ আছি কাল কোথায়
রব' বা 'সাগরিকা'-র 'হৃদয় আমার সুন্দর তব পায় ' যেন কোনদিনই পুরাতন হওয়ার
নয়।
গান - আজ আছি কাল কোথায় র'ব
গান - হৃদয় আমার সুন্দর তব পায়
বহু ছবিতে দ্বৈতসঙ্গীতও পরিবেশন করেছেন আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়,
যার মধ্যে 'পৃথিবী আমারে চায়' ছবিতে শ্যামল মিত্র সহিত 'কেউ নয় সাহেব বিবি ' বা
'তাসের ঘর' ছবিতে রবিন মজুমদারের সঙ্গে 'নীরবে যত কথা', রসিক শ্রোতা আজও ভোলেন নি।
গান - কেউ নয় সাহেব বিবি
গান - নীরবে যত কথা
সহশিল্পী শ্যামল মিত্রের সঙ্গে আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়
(সৌজন্যে : শ্রী শ্রীধর মুখোপাধ্যায়)
(সৌজন্যে : শ্রী শ্রীধর মুখোপাধ্যায়)
ছায়াছবির গানের পাশাপাশি চলতে থাকে পুজোয়, বসন্ত বন্দনায়, সঙ্গীত পরিবেশন। রবীন
চট্টোপাধ্যায়, নচিকেতা ঘোষ, শ্যামল মিত্র, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়,
ভূপেন হাজারিকা, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, প্রমুখ সেকালের প্রখ্যাত সুরকারদের
প্রায় সকলের সুরেই গেয়েছেন আলপনা। ১৯৫৫-র পুজোর গান, 'আবছা মেঘের ওড়না গায়ে' (কথা -
শ্যামল গুপ্ত, সুর - শ্যামল মিত্র), ১৯৫৭-র পুজোর 'তারাদের চুমকি জ্বলে' (কথা -
পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, সুর - ভূপেন হাজারিকা), ১৯৫৮-র পুজোর রেকর্ডের
'বকুলগন্ধে যদি বাতাস' (কথা - পবিত্র মিত্র, সুর - নচিকেতা ঘোষ), প্রভৃতি গান
শুনতে আজও ভালো লাগে।
গান - আবছা মেঘের ওড়না গায়ে
গান - তারাদের চুমকি জ্বলে
গান - বকুলগন্ধে যদি বাতাস
আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রসঙ্গ আলোচনা, অথচ ছোটদের গানের কথা
নেই, তা কি হয়? সে যে অন্য এক জগত - যেখানে সুরের মূর্ছনায় ভাসিয়ে ছোট ছোট শিশুদের
শিল্পী পৌঁছে দেবেন কল্পলোকে! লৌকিক ছড়া 'যমুনাবতী সরস্বতী' থেকে দু-লাইন নিয়ে
সুন্দর গান রচনা করেছিলেন ভাস্কর (অরুণকুমার) বসু - 'যমুনাবতী সরস্বতী, কাল
যমুনা লীলাবতী - কাজিতলার ঘাটে বাঁধা যমুনাবতীর নাও', তেমনি মিষ্টি
লোকাশ্রয়ী সুর দিয়েছিলেন নচিকেতা ঘোষ -শিল্পী আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়।
গান - যমুনাবতী সরস্বতী
আবার নেপালি গানের সুর ভেঙে, ভাস্কর বসুর কোথায় সুধীন
দাশগুপ্ত সুর বসালেন, 'পৌষালি সন্ধ্যা ঘুম ঘুম তন্দ্রা' - সেও কি ভোলা যায়!
গান - পৌষালি সন্ধ্যা ঘুম ঘুম তন্দ্রা
১৯৫০-এ আরম্ভ করে, ১৯৫৯ অবধি শুধু জয়েরই ইতিহাস - প্রায় প্রতি
বছরই একাধিক গ্রামোফোন রেকর্ড প্রকাশ, বহু ছবিতে সঙ্গীত পরিবেশনের সুযোগ! ১৯৫৯-এ
শ্রী শ্রীধর মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিবাহের পর, গ্রামোফোন রেকর্ড ও ছায়াছবির
গানের জগত থেকে বিদায় নিলেও, দেশে-বিদেশে বহু অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন
করেছেন আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায় (তখন মুখোপাধ্যায়)।
সঙ্গীত পরিবেশনরত আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষজীবনে, স্মৃতিচারণে শিল্পী উল্লেখ করেছিলেন দুটি স্মরনীয়
অনুষ্ঠানের কথা। প্রথমটি ছিল ১৯৭৮-এ 'ভয়েস অফ আমেরিকা'-য় অসীম আগ্রহী শ্রোতাদের
জন্য 'হাট্টিমাটিম টিম' ও 'যমুনাবতী সরস্বতী' গাওয়া, অন্যটি ১৯৮৭-এ বিবিসি-তে
সঙ্গীত পরিবেশন।
"আলপনারও একটা নিজস্বতা ছিল। ও খুব বোল্ড গাইত। পরিষ্কার
উচ্চারণ...", স্মৃতিচারণে বলেছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। আরও বলেছিলেন,
"আলপনা পরিষ্কার পরিছন্ন থাকতে ভালবাসে, সে দেখতে সুন্দরী, সাজগোজ করে, গান
গায়, সবই জানি। কিন্তু ওর রান্নার হাত দেখে আমি অবাক হয়ে
গিয়েছিলাম!"
ছোট্ট পাখী চন্দনার গান, চাঁপার কলির গন্ধ,
শালুকের দোদুলদুলের মধ্য দিয়েই আজও ডাক দিয়ে যান আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়।
শ্রোতাকে আবিষ্ট করে রাখেন তাঁর মায়াভরা কন্ঠের নস্টালজিয়ায়...
গান - ছোট্ট পাখী চন্দনা