Thursday, 23 July 2015

জেনো দুটি নয়ন তার, জ্যোছ্না বিলাতে জানে

                                     কিছু গান, কারণে-অকারণে, নানা অনুসঙ্গের মধ্য দিয়ে, বিশেষভাবে মনে থেকে যায়। কখনো বা সেসব গান হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে ব্যক্তিগত কোনো স্মৃতির ঝলকানিতে, কখনো বা কারো স্মৃতিচারণায়। সুর-বাণী সমন্বয়ের সেসব সুন্দর সৃষ্টি কোনো এক-মূহূর্তের দীপনে, অবচেতনের গভীর থেকে হঠাৎ স্পষ্ট হয়ে উঠে, সচেতনের পটে আঁকতে থাকে একের পর এক ছবি। সেসব ছবির ওপর মনের তুলির রং বোলাতে বোলাতে, আবার সেই অবচেতনেই যাত্রা। এ অনন্ত যাত্রার নির্যাস, কিছু ভালো লাগা গান!




(দূরদর্শনে আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিবোর্ড ও এ্যাকর্ডিয়ন সঙ্গতে ভি বালসারা। তবলায় সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়।)


                                     প্রিয় শিল্পী আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রয়াণবার্ষিকীর প্রাক্কালে, এমনই এক ভালো-লাগা গান, মনের মধ্যে সুর-বাণী-ছন্দের খেলা খেলে চলেছে অবিরাম!


রেকর্ডকৃত - ফেব্রুয়ারী, ১৯৫৮

গীতিকার - শ্যামল গুপ্ত

সুরকার - ভি বালসারা

শিল্পী - কুমারী আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়

(আকাশবাণী কলকাতার 'রম্যগীতি' অনুষ্ঠানের গান)




চাঁদ তুমি ঘুমাতে পার,

যে আছে চেয়ে মোর পানে,

জেনো দুটি নয়ন তার,

জ্যোছ্না বিলাতে জানে।

চাঁদ তুমি ঘুমাতে পার!


পাপিয়া তুমিও না শোনাও যদি গান,

হবেনা গানের বেলা তাও অবসান,

এ হৃদয় দেবে তো ভরে,

সাথী মোর মিলন গানে। 

চাঁদ তুমি ঘুমাতে পার!


যদি চাও বনের মুকুল,

যেও তুমি না হয় ঝরে,

দু'জনার বরণমালা,

গাঁথা হবে মনের ডোরে।


রজনী তুমিও যদি ভোর হয়ে যাও,

এ মধুলগন যেন ফুরাবে না তাও,

মরমের ভুবনে তারে,

অনুরাগ ফিরায়ে আনে।

চাঁদ তুমি ঘুমাতে পার!


                                     এ সুরে কেমন যেন একটা 'স্বপ্ন-স্বপ্ন' উপাদান আছে - অবচেতনেই গুনগুনিয়ে ওঠে, নিজে থেকেই - কোনো ভালো-লাগার মূহূর্তে! সুরের রেশটি, কি সুন্দরভাবে ধরে রাখে বালসরাজির পিয়ানোবাদন! মাঝেমাঝে মায়াভরা কন্ঠে একরাশ আবেগ নিয়ে গেয়ে ওঠেন আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়।

                                     এই মুগ্ধতা, এই মায়াবী আবেশ, বারবার পৌঁছে দেয় নস্টালজিয়ার দোরগোড়ায়। সে নস্টালজিয়ায় খানিক বাস্তবের নির্যাস, বাকিটা মনের তুলিতে আঁকা, কল্পনার রঙে রাঙানো - সে এক একান্ত নিজস্ব অনুভূতি। এ নস্টালজিয়ার স্রষ্টা ব্যক্তি শ্রোতাই!



(সঙ্গীত পরিবেশনরত আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়)


                                     কলকাতা হাসপাতালে, জীবনের অন্তিম লগ্নে, আলপনাকে কাছে ডেকে, এ গান শোনাতে বলেছিলেন বালসারাজি। গেয়ে শুনিয়েছিলেন অশ্রুসিক্ত শিল্পী।


চাঁদ তুমি ঘুমাতে পার,

যে আছে চেয়ে মোর পানে,

জেনো দুটি নয়ন তার,

জ্যোছ্না বিলাতে জানে।

চাঁদ তুমি ঘুমাতে পার!


                                     চাঁদ ঘুমিয়েছে। চাঁদের মাধুর্যে গড়া যে চোখ জ্যোৎস্না বিলায়, সে জেগে। সে চোখ চিরন্তন। ছোট্ট পাখি চন্দনার গান, চাঁপাকলির গন্ধ, শালুকের দোদুলদুলের মধ্য দিয়ে সে গীতিজ্যোৎস্না, আলপনা এঁকে যায় আলোয়-ছায়ায় - আজও! আর দেখে সে চোখ - জ্যোৎস্না বিলায় - দেখে, জ্যোৎস্না বিলায় - আবার দেখে। এ দেখা অন্তহীন!

Friday, 13 March 2015

খুকুর ছড়া

ছোটদের গানই বেশীরভাগ সময় গেয়ে থাকেন শিল্পী সঙ্গীত বিষয়ক এক পত্রিকায় কোনো এক একনিষ্ঠ শ্রোতা তাঁর উদ্দেশ্যে লিখলেন - "আপনি বোধ হয় একটু শিশু বৎসল, না? আপনার ছোটদের জন্য গানগুলি ভালো লাগে।" শিল্পীর উত্তর - "অশেষ ধন্যবাদ শিশু বাৎসল্য তো মানব প্রকৃতি।" 


আসলে যাঁর গান শুনে দশকের পর দশক বাংলার ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা কল্পনার জগতে ভেসে বেড়িয়েছে, যাঁর গান শোনার জন্য তারা মুখিয়ে থেকেছে, তাদের স্বপ্নের শিল্পীর এমন উত্তরই  বোধ হয় স্বাভাবিক যাঁর কন্ঠে 'হাট্টিমাটিম টিম' বা ' আমার ছোট্ট পাখি চন্দনা' শুনে আজও মন কেমন করে ওঠে, ফিরে যেতে ইচ্ছা করে সেই ছোট্টবেলায়, তাঁর কাছে বাৎসল্য কখনই আরোপিত কিছু হতে পারেনা


ঘুম-ঘুম-তন্দ্রা ভরা পৌষালি সন্ধ্যায়, মিঠে গলায় চন্দনার শিস-তোলা সেই শিল্পী, আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়




পি.কে.সেনের সঙ্গে, এইচএমভি'তে    
যাত্রা শুরু হয়েছিল অবশ্য প্রচলিত ধাঁচের 'আধুনিক' গান গেয়েই সে গান জনপ্রিয় হাওয়ায়, ডেকে পাঠালেন এইচএমভি' অধিকর্তা, পি.কে.সেন জানতে চাইলেন, ভবিষ্যতে  কি ধরণের গান গাইতে চান শিল্পী কিশোরী আলপনার উত্তর - "সকলেই তো বড়দের গান করে, আমি ছোটদের গান গাইব আমার অনেক বন্ধু আছে, সেসব গান তারা শুনবে - আমায় বলবে, 'কী সুন্দর তুই গান করেছিস!' আমার কী মজা হবে!" কার্যত, 'ছোটদের গান' রেকর্ড করার রেয়াজ ছিল না, পঞ্চাশের গোড়ার রেকর্ড-সঙ্গীত-জগতে তবু আর্জি রেখেছিলেন স্নেহশীল অধিকর্তা কিশোরী শিল্পীর উৎসাহ তাঁকে যেমন অনুপ্রাণিত করেছিল, তেমন শিল্পীর দক্ষতার ওপরেও সম্পূর্ণ আস্থা তাঁর ছিল আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্ঠে প্রকাশিত হল ছোটদের গান - 'খুকু যাবে শ্বশুরবাড়ি', 'আয় রে আয় ছেলের পাল' সে রেকর্ডের জনপ্রিয়তা সম্বন্ধে মন্তব্য করা নিষ্প্রয়োজন - কারণ তারপর থেকে, প্রতি বছরই (১৯৫৯ পর্যন্ত) শিল্পীর কন্ঠে প্রকাশিত হয়েছে ছোটদের গানের রেকর্ড সেসব গানের আবেদন, রসিক শ্রোতার কাছে আজও হারায়নি! এই অশেষ জনপ্রিয়তা, কিশোরী আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আত্মপ্রত্যয়ের কথাও নিশ্চয়ই মনে করিয়ে দেয়!


গান - খুকুর ছড়া (প্রথম ভাগ)

কথা - প্রচলিত

সুর - নির্মল ভট্টাচার্য্য

শিল্পী - কুমারী আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়



খুকু যাবে শ্বশুরবাড়ি, সঙ্গে যাবে কে
বাড়িতে আছে হুলো বেড়াল, কোমর বেঁধেছে
আম কাঁঠালের বাগান দেব, ছায়ায় ছায়ায় যেতে 
শান বাঁধানো ঘাট দেব, পথে জল খেতে।।
ঝাড়লন্ঠন জ্বেলে দেব, আলোয় আলোয় যেতে
উড়কি ধানের মুড়কি দেব, শাশুড়ি ভুলাতে।। 
শাশুড়ি ননদ বলবে দেখে, বউ হয়েছে কালো
শ্বশুর ভাসুর বলবে দেখে, ঘর করেছে আলো।। 

ঘুমপাড়ানি মাসি পিসি, আমার বাড়ি এসো
জল পিঁড়ি দেব তোমায়, পা ধুয়ে বোসো।।
চাল কড়াই ভাজা দেব, যত খেতে চাও
দাঁত না থাকে গুঁড়িয়ে দেব, কষ্ট নাহি পাও।। 
বাটা ভরে পান দেব, গাল ভরে খাও 
যত ছেলের চোখের ঘুম, খোকার চোখে দিও।।

আয় ঘুম আয়, আয় ঘুম আয়, আয় ঘুম আয়
আয় ঘুম আয়, আয় ঘুম আয়, আয় ঘুম আয়।।

গান - খুকুর ছড়া (দ্বিতীয় ভাগ)

কথা - প্রচলিত

সুর - নির্মল ভট্টাচার্য্য

শিল্পী - কুমারী আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়



আয় রে আয় ছেলের পাল, মাছ ধরতে যাই
মাছের কাঁটা পায়ে ফুটেছে, দোলায় চেপে যাই।।
দোলায় আছে 'পণ কড়ি, গুনতে গুনতে যাই
বড় শাঁখাটি ছোট শাঁখাটি, ঝামুর ঝুমুর করে ।।
তিন কড়ায় খয়ের কিনে, দুগ্গা হেন জ্বলে
আজ দুগ্গার অধিবেশ, কাল দুগ্গার বে'।।
তিন মিনসে নেড়া ফকির, কোমর বেঁধেছে
কোমরে কদম্বের ফুল, ফুটে উঠেছে ।।

আয় রে আয় টিয়ে,
না' ভরা দিয়ে
না' নিয়ে গেল বোয়াল মাছে,
তা দেখে দেখে ভোঁদর নাচে
ওরে ভোঁদর ফিরে চা,
খোকার নাচন দেখে যা ।।
  
আয় চাঁদ নড়িয়া,
ভাত নেব বাড়িয়া
মাছ কেটে মুড়ো দেব,
ধান ঝেড়ে কুঁড়ো দেব
রাঙা সুতোর কাপড় দেব,
চড়ে বেড়াতে ঘোড়া দেব
খোকার কপালে টিপ দিয়ে যা।।

আমার কথাটি ফুরালো,
নোটে গাছটি মুড়োলো
ক্যান রে নোটে মুড়োলি,
গরুতে কেন খায়
ক্যান রে গরু খাস,
রাখাল কেন চড়ায় না
ক্যান রে রাখাল চড়াস না,
বউ কেন ভাত দেয় না
ক্যান রে বউ ভাত দিস না,
কলাগাছ কেন পাত ফেলে না
ক্যান রে কলাগাছ পাত ফেলিস না,
জল কেন হয় না
ক্যান রে জল হোস না।।

আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্মদিনে, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য!